সুন্দর পরিবেশনে সুস্বাদু মুরগির রোস্ট তৈরি করুন ঘরেই!
বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরের রান্নাঘরে মুরগির রোস্ট একটি অত্যন্ত পরিচিত ও জনপ্রিয় রান্না।
এটি শুধু একটি সাধারণ খাবার নয়, বরং একটি আবেগ, একটি ঐতিহ্য। বিয়েবাড়ি, ঈদের দাওয়াত, বা যেকোনো উৎসবমুখর আয়োজন মুরগির রোস্ট ছাড়া যেন জমেই না।
সুগন্ধি মসলা, ঘন গ্রেভি, এবং কোমল মুরগির মাংসের মেলবন্ধনে এই খাবারটি যেন রুচিতে আনে রাজকীয় স্বাদ।
রোস্ট শব্দটি ইংরেজি "Roast" থেকে এসেছে, যার মানে সাধারণত আগুনে বা ওভেনে রান্না করা।
তবে আমাদের উপমহাদেশে রোস্ট মানে শুধুমাত্র ওভেন বা গ্রিল নয়, বরং মসলার সাথে ঝরঝরে অথচ রিচ গ্রেভিতে রান্না করা একটি বিশেষ ধরনের মুরগির তরকারি।
অনেকেই একে "বিয়ের রোস্ট" বলেও চেনেন কারণ এটি বিয়েবাড়ির মেনুতে একদম অপরিহার্য।
মুরগির রোস্ট রান্নার রেসিপি
এবার আমরা বিস্তারিত ভাবে দেখে নেব কীভাবে ঘরেই সহজ উপায়ে রেস্তোরাঁ বা বিয়েবাড়ির মতো স্বাদে মুরগির রোস্ট রান্না করা যায়।
প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ
মুরগির জন্য:
- মুরগি – ১টি (১ কেজি বা মাঝারি আকৃতির, ৪ টুকরো করে কাটা)
- দই – ১/২ কাপ
- আদা বাটা – ১ টেবিল চামচ
- রসুন বাটা – ১ টেবিল চামচ
- পেঁয়াজ – ৩টি মাঝারি (বাদামি করে ভেজে পেস্ট করে নেওয়া)
- পেঁয়াজ কুচি – ১ কাপ
- টক দই – ১/২ কাপ (ঝোল ঘন করতে সাহায্য করে)
- টমেটো – ১টি মাঝারি (পেস্ট করা)
- গরম মসলা – ১ চা চামচ (দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ বাটা)
- লবণ – স্বাদমতো
- চিনি – ১ চা চামচ (স্বাদ ভারসাম্য রাখতে)
- ঘি বা তেল – ১/২ কাপ (রোস্টের আসল স্বাদ আনতে ঘি ভালো)
রং ও সুগন্ধির জন্য:
- জাফরান – সামান্য (দুধে ভিজিয়ে রাখা)
- কেওড়া জল – ১ চা চামচ
- গোলাপ জল – ১/২ চা চামচ
- দারুচিনি স্টিক – ২ টুকরো
- তেজপাতা – ২টি
রান্নার প্রণালি
ধাপ ১: মুরগি ম্যারিনেট করা
প্রথম ধাপেই মুরগির টুকরো গুলোকে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিন। এরপর একটি বড় বাটিতে মুরগির সাথে দিন দই, আদা-রসুন বাটা, লবণ, সামান্য চিনি, অল্প গরম মসলা গুঁড়া এবং টমেটো পেস্ট। ভালোভাবে মিশিয়ে ঢেকে রাখুন কমপক্ষে ১ ঘণ্টা (রাতভর রাখলে আরও ভালো)। এই ম্যারিনেশন মাংসকে কোমল করে এবং মশলার স্বাদ ভেতরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
ধাপ ২: পেঁয়াজ ও অন্যান্য উপকরণ তৈরি
এবার একটি প্যানে ঘি বা তেল গরম করে তাতে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে বাদামি করে ভেজে নিন। এরপর সেটিকে তুলে রেখে একই তেলে দারুচিনি, তেজপাতা ফোড়ন দিন। এরপর ম্যারিনেট করা মুরগির টুকরো গুলো দিয়ে দিন এবং কিছুক্ষণ নাড়ুন।
মাঝারি আঁচে ১০-১৫ মিনিট কষাতে থাকুন যতক্ষণ না মুরগির কাঁচা ভাব কেটে যায় এবং তেল ছাড়তে শুরু করে।
ধাপ ৩: রোস্টের ঝোল তৈরি
এবার ভাজা পেঁয়াজ পেস্ট, বাকি দই, অল্প পানি ও লবণ দিয়ে দিন। ঝোল যেন বেশি পাতলা না হয়, ঘন ও তেলতেলে হওয়া উচিত। এরপর ঢেকে ২০ মিনিট মতো রান্না করুন। মাঝে মাঝে নাড়তে ভুলবেন না।
ঝোল যখন ঘন হয়ে আসবে, তখন দিন জাফরান দুধ, কেওড়া জল, ও গোলাপ জল। একেবারে শেষে সামান্য চিনি দিয়ে স্বাদ চেক করে নিন। চুলা বন্ধ করে ঢেকে রাখুন আরও ৫ মিনিট, যাতে সুগন্ধ মাংসে মিশে যায়।
পরিবেশনের ধরন
মুরগির রোস্ট পরিবেশন করা যায় পোলাও, ফ্রাইড রাইস, বা পরোটার সাথে। যেহেতু এটি একটি ভারী পদ, তাই পাশাপাশির কোনো হালকা সালাদ বা দই হতে পারে উপযুক্ত সহচর। রোস্ট সাধারণত একটি উৎসবমুখর পরিবেশের রান্না—তাই প্লেট সাজানোয় একটু যত্ন নেওয়া রুচি বাড়িয়ে তোলে।
চাইলে উপর থেকে কয়েকটি ভাজা কাঁচা মরিচ এবং পেঁয়াজের বেরেস্তা ছড়িয়ে দিতে পারেন পরিবেশনের আগে।
রান্নার কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
ঘি ও দই: রোস্টের আসল স্বাদ ঘি ও টক দই থেকে আসে। তাই এ দুটো উপাদানে যেন কার্পণ্য না হয়।
ভাজা পেঁয়াজ: পেঁয়াজ ভাজা যত ভালো হবে, রোস্ট ততই সুস্বাদু হবে। বাদামি কিন্তু পোড়া নয়—এই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
ম্যারিনেশন: ম্যারিনেট করার সময় যেন কম না হয়। আদা-রসুন ও দই মুরগিকে কোমল করে তোলে এবং গন্ধও কমায়।
তেল ছাড়লে বুঝবেন রোস্ট প্রস্তুত: যখন রান্নার শেষে ঘি বা তেল উপরে উঠে আসবে, তখন বুঝতে হবে রোস্ট তৈরি হয়ে গেছে।
রোস্টের পুষ্টিগুণ
মুরগির রোস্ট সাধারণত উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ একটি পদ। বিশেষ করে যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন বা শরীর গঠন করছেন, তাদের জন্য প্রোটিন প্রয়োজন। তবে যেহেতু এতে ঘি ও তেল ব্যবহার হয়, তাই যারা ক্যালোরি কনশাস, তারা পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করবেন।
টক দই রোস্টে ক্যালসিয়াম ও প্রোবায়োটিক গুণ যুক্ত করে, যা হজমে সহায়তা করে। মশলাগুলো যেমন দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ এগুলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ।
উপসংহার:
মুরগির রোস্ট শুধু একটি রান্নার পদ নয়, এটি বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। ঘরে তৈরি রোস্ট শুধু স্বাদেই নয়, ভালোবাসায়ও পরিপূর্ণ হয়।
একজন গৃহিণী যখন পরিবারের জন্য সময় নিয়ে, যত্ন নিয়ে মুরগির রোস্ট রান্না করেন, তখন সেই পদ আর কেবল খাবার থাকে না, তা হয়ে ওঠে পারিবারিক বন্ধনের এক অনন্য রূপ।
সঠিক উপকরণ, ধৈর্য, এবং ভালোবাসা থাকলে আপনি ঘরেই তৈরি করতে পারেন বিয়েবাড়ির মতো সুস্বাদু রোস্ট। রান্নায় সৃজনশীলতা থাকলে একটি সাধারণ রেসিপিও হয়ে উঠতে পারে একেবারে অসাধারণ।
রোস্ট রান্না করতে গিয়ে একেক জনের একেক টুইস্ট থাকেই। কেউ একটু বেশি মিষ্টি পছন্দ করেন, কেউবা ঝাল। কেউ রোস্টে বাদাম পেস্ট দেন, কেউ কাঁচা মরিচ। তাই রোস্টের কোনও একক রেসিপি নেই—যা আছে, তা হলো আবেগ, অভিজ্ঞতা আর ভালোবাসা।
তাই আজই সময় বের করে রান্নাঘরে ঢুকে দেখিয়ে দিন—আপনার হাতেও লুকিয়ে আছে সেই স্বাদ, যা মনে রাখবে সবাই।
শুভ রান্না!

দারুন লেখা